বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

আওয়ামী লীগ সংকট নিরসনের ঐতিহাসিক দায়িত্ব অর্জন করেছে

গাজীউল হাসান খান


পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে ৬৩ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তৎকালীন পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য বিকল্পধারার যে রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, আজ তার সব গৌরবের চেয়ে দায়িত্ব বেড়েছে আরো অনেক বেশি। শুধু এ ভূখণ্ডের মানুষের ভাষা-সংস্কৃতিসহ অন্যান্য আর্থ-সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ লড়াইয়ে সম্পৃক্ত থাকাই নয়, স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্বও বর্তেছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতাদের ওপরই। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী মানুষের আস্থা অর্জনকারী এ দলটির কাছে নূ্যনতম আর কোনো বিকল্প ছিল না তখন। তাই দলনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানেও স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারীর গৌরব ও মর্যাদা লাভ করেছিল এ দলটি। তা ছাড়া ১৯৫৪-এ ২১ দফার ভিত্তিতে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ফ্রন্ট ২২৮টি আসন লাভ করেছিল। তার মধ্যে নবগঠিত আওয়ামী লীগ একাই পেয়েছিল ১৪৩টি আসন। তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৭০-এ অনুষ্ঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ভাসানীর উত্তরসূরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দুটি বাদে সব কয়টি আসনই লাভ করেছিল আওয়ামী লীগ। সে কারণেও আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। তৎকালীন পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে আওয়ামী লীগ একটি উজ্জ্বল ধারার সৃষ্টি করেছিল। এটি কেউ অস্বীকার করার চেষ্টা করতে পারবে না। এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ধারা বেয়ে আওয়ামী লীগ বিগত ৬৩টি বছর পেরিয়ে এসেছে। অতিবাহিত প্রায় এ সাড়ে ছয়টি দশকে তাদের অনেক নেতা-কর্মীকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে কখনো দেশের সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে, আবার কখনো গণতন্ত্র রক্ষা কিংবা তাকে পুনরুদ্ধারের স্বার্থে।
জন্মলগ্নে আওয়ামী লীগের প্রথম ম্যানিফেস্টো রচনা করেছিলেন মরহুম জননেতা শামসুল হক। পরে ১৯৬৪ সালের মার্চ, ১৯৬৬ সালের মার্চ এবং ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত সংশোধনীগুলো অন্তর্ভুক্ত করে দলের 'নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা' প্রকাশিত হয়, যা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বহাল থাকে। সে ঘোষিত নীতিতে বলা হয়েছে, "আওয়ামী লীগ একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান।... ইহা অত্যন্ত দৃঢ়তার সহিত বিশ্বাস করে যে জনগণই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পরিচালিত হইবে।... সরকার হইবে 'পার্লামেন্টারি' ধরনের, যাহাতে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আইনসভা হইবে সার্বভৌম।" এ ধরনের সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ নীতি ও কর্মসূচি নিয়েই একদিন আওয়ামী লীগ তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। এ দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও একটি সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল তাদের চূড়ান্ত। তা ছাড়া একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন ও সব পর্যায়ে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রত্যয়ও ছিল আপসহীন। একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শগত দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে। তাই বর্তমানে বিরাজিত রাজনৈতিক সংকট নিরসনে, অর্থাৎ একটি নিরপেক্ষ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে যাবে না এবং অপরদিকে বর্তমান নির্বাচিত সরকারের অধীনেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আওয়ামী লীগকেই বিবেচনা করতে হবে বেশি। এ ব্যাপারে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পেতে উলি্লখিত এ দুই পক্ষকেই গণতন্ত্র ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে। জাতীয় সংসদের বর্তমান নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে আনুপাতিক হারে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করার বিষয়টিও ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে। উভয় পক্ষের একগুয়েমির কারণে চরম নৃশংসতা, বিশৃঙ্খলা ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যকলাপ দেশে সংঘটিত হতে দেওয়া যেতে পারে না। তা দেশপ্রেমিক ও শান্তিপ্রিয় কোনো নাগরিকেরই কাম্য হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যথেষ্ট দায়-দায়িত্ব রয়েছে বলে সাধারণ মানুষ মনে করে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাঁর নিজ দলের ৬৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় নেতা-কর্মীদের সব ধরনের জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ থেকে হুঁশিয়ার থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে দলের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড পরিচালনার ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁদের মতে, আওয়ামী লীগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক নবীন এ দলটি একটানা ৯ বছর এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। কখনো কোনো ইস্যুতে আপস না করে তার পতন ঘটিয়েছে। স্বাধীনতার পর, অর্থাৎ ১৯৭২-এ প্রণীত সংবিধান সংশোধন করে ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ দেশে একটি একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের উদ্যোগেই আবার দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছিল। তা ছাড়া তার আরো অনেক পরে সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী এনে বিএনপিই আবার বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করেছিল। ১৯৯১ সালে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসে অপেক্ষাকৃত তরুণ এ দলটির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সে মহান উদ্যোগটি নিয়েছিলেন। তা ছাড়া বিএনপির নেতাদের মতে, তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, বিদ্যুৎ উৎপাদনে চরম ব্যর্থতা এবং জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের যত মনগড়া অভিযোগই করা হোক না কেন, অতীতে প্রায় দেড় দশককাল ক্ষমতায় থাকার সময় এ দলটি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ একাই সম্পন্ন করেছে (তথ্য : ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট)। তা ছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এ দেশের উন্নয়নের সব ক্ষেত্রেই আধুনিকতার ছাপ রেখে গেছেন বলে তাঁদের দাবি। তাঁদের মতে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও স্বৈরতান্ত্রিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম অবমাননা করেছে। একদিন জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য লাগাতার আন্দোলনে দেশ অচল করে দিয়েছিল। তখন তারা বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ে কিংবা একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে কোনো কথা বলেনি। অথচ আজ ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার রক্ষা এবং বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুমসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পাশ্চাত্য দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান। সেদিন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরে এসে প্রকাশ্যেই সে অভিযোগ করে গেলেন। কেউ তার কোনো জবাব দিতে পারেনি।
গণতান্ত্রিক আন্দোলন কিংবা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে সব বড় রাজনৈতিক দলেরই হয়তো অনেক সাফল্যের পাশাপাশি কিছু ব্যর্থতার ইতিহাসও থাকে। সবাই তাদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলে। তবে কেউ নেয়, আবার কেউ জেনে-শুনেই সব কিছু অগ্রাহ্য করে। কায়েমী স্বার্থে সব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিই কম-বেশি অন্ধ হয়ে পড়ে। প্রগতিশীলরাই এগিয়ে যেতে সক্ষম হয় তাদের ঘোষিত নীতি, আদর্শ এবং সর্বোপরি জনগণের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ও দায়িত্ববোধের কারণে। আগামী সাধারণ নির্বাচনের এখনো প্রায় দেড় বছর বাকি থাকলেও নির্বাচনকালে একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রশ্নে ক্ষমতাসীন সরকার ও প্রধান বিরোধী জোটের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। এ বিরোধকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে যে সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষকে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ব্যবসায়ী মহল, বিশেষ করে পণ্য উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকরা অত্যন্ত দুর্ভাবনার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি হুমকির মুখে পড়ুক কিংবা সংবিধান বহির্ভূত কোনো তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটুক, তা যেমন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বাধীন শরিক দলগুলো চায় না, তেমনি বিরোধী জোটও এই একটি ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেছে। এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও দলগত নীতি-আদর্শের কারণেই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের শাসন ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করা তাদের একটি অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। সামনে আসছে সিয়াম সাধনার মহান মাস। ধৈর্য, ত্যাগ ও এক অপরের প্রতিযত্নশীল হওয়ার তাগিদ। দেশ ও জাতির জন্য দায়িত্ব পালন, আত্মত্যাগ ও সব ধরনের কায়েমী স্বার্থ ত্যাগের প্রকৃষ্ট সময়। এ সময় দেশে সংঘাত, হানাহানি ও অরাজকতা সৃষ্টির সম্ভাব্য সব পথ বন্ধ করা এবং শান্তিপূর্ণভাবে ভবিষ্যৎ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি পন্থা উদ্ভাবন করাই হবে রাজনীতিবিদদের একটি নৈতিক দায়িত্ব। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে সংকট নিরসনের সে ঐতিহাসিক দায়িত্ব অর্জন করেছে।

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন